আজ

  • সোমবার
  • ২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সুন্দর সমাজ গড়তে নৈতিকতার বিকল্প নেই

  • নূর শাহ মোহাম্মদ আজাদ
  • বর্তমান বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষা-দীক্ষা, আধুনিকতা ও উন্নয়নে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ডিজিটাল যুগ অতিবাহিত করছে এই দেশ। এরই মধ্যে দেশের সমাজ ব্যবস্থায় বিভিন্ন কারণে দূর্নীতি, ধর্ষণ, আত্মহত্যা, খুন, শিশু ও নারী নির্যাতন, ভূমি দখল, মুক্তিপন আদায়, সন্ত্রাসবাদ, মাদক, মারামারি, হানাহানি, অস্থিরতাসহ বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা। যা প্রতিদিন দৈনিক পত্রিকা, ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া, সমাজিক যোগাযোগসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে।

    সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ মূল্যবোধ তথা মানুষগুলোর নৈতিক অবক্ষয়। নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে আজ সন্তানদের কাছে পিতা-মাতা নিরাপদ নয়, পিতামাতার কাছে সন্তানরা নিরাপদ নয়, শিক্ষকদের কাছে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ নয়, শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষকরা নিরাপদ নয়, ডাক্তারের কাছে রোগী নিরাপদ নয়, চাচার কাছে ভাতিজি নিরাপদ নয়, সমাজে ছোট্ট শিশুরা নিরাপদ নয়! কিছু কিছু ঘটনা ঘটে যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

    উদারণ স্বরুপ আমরা দেখতে পাই ঐষির মত সন্তান পিতা-মাতার খুনি। ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত হত্যাসহ এরূপ শত শত উদারণ আমাদের সমাজে রয়েছে।

    এসকল অসামাজিক ও অস্থিরতা থেকে বাচাঁর একমাত্র উপায় নৈতিক শিক্ষা। প্রত্যেককে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলে আমরা সুন্দর একটি সমাজ, সুন্দর একটি রাষ্ট্র ও সুন্দর একটি পৃথিবী গড়তে পারবো। ইসলাম ধর্মে নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।

    আমরা প্রথমে নৈতিকতা কি তা বুঝার চেষ্টা করি। একজন মানুষ এবং পশুর মধ্যে পার্থক্য হলো মানুষের বিবেক। যেটি নৈতিকতা দ্বারা পরিচালিত হয়। যে ব্যক্তির মাঝে নৈতিক শিক্ষা রয়েছে, তার বিবেক বলে দিবে কোন কাজটি ভালো আর কোন কাজটি খারাপ। কোন কাজটি করলে সমাজে ক্ষতি হবে আর কোন কাজটি করলে সমাজ উপকৃত হবে। তার দ্বারা কোন ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রের ক্ষতি হচ্ছে কিনা তা বিবেক বলে দিবে। পরিচালিত এই বিবেকই হচ্ছে নৈতিকতা।

    পক্ষান্তরে যার নৈতিক শিক্ষা নেই, তার ভালো-মন্দের বিচার করার ক্ষমতা নেই। সেই সমাজে পশুর মত আচরন করে। পিতা-মাতার সাথে কেমন আচারণ করবে সেই বোধগম্য তার কাছে নেই। তার হিতেহিত জ্ঞানের অভাবে সেই সমাজে যেকোন কাজ করতে পরোয়া করে না। রক্তে মাংসে মানুষ হলেই তাকে মানুষ বলা যায় না। যদি তার মাঝে নৈতিকতা না থাকে। একজন ব্যক্তি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন করলেও তার মাঝে নৈতিক শিক্ষা না থাকলে তাকে মানুষ বলা যায় না। টাকা অর্জন করলেও তাকে মানুষ বলা যায় না। যদি তার মধ্যে নৈতিকতা না থাকে। উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করলেও তাকে মানুষ বলা যায় না, যদি নৈতিকতা না থাকে। দেশে দূর্নীতির প্রধান কারণই হচ্ছে নৈতিকতার অবক্ষয়। নৈতিকতা নেই বলেই তারা দূর্নীতি গ্রস্থ। আশার কথা হল, বর্তমানে বিসিএস পরীক্ষায় ১০ নাম্বারের প্রশ্ন থাকে সুশাসন, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার উপর।

    নৈতিকতা এমন একটি শিক্ষা, যা অর্জন করে নিতে হয়। কারণ নৈতিক শিক্ষার কোন সার্টিফিকেট নেই। এখন কথা হলো কোথায় থেকে এই শিক্ষা অর্জন করতে হবে। সমাজে কেউ শিক্ষিত হয়ে জন্মগ্রহন করে না, আবার কেউ অপরাধী হয়েও জন্ম গ্রহন করে না। মানুষ পরিবেশ-পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করেই বেড়ে উঠে। এক্ষেত্রে নৈতিকতা শিক্ষায় প্রথম ভূমিকা রাখতে হয় পরিবারকে। এরপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে। এই নৈতিক শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে রাষ্ট্রের উপরও।

    একটি শিশুর নৈতিক শিক্ষার ভিত্তি পরিবার থেকে বপন করতে হয়। তাকে বুঝাতে হবে ভালো মন্দের পার্থক্য। ছোট-বড়দের সাথে কিভাবে আচার-আচারণ করতে হবে। দিতে হবে ধর্মের জ্ঞান। একমাত্র ইসলাম ধর্মই পারে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে।
    একজন ব্যক্তি যখন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য যাবে। তখন তাকে আরো বিষদভাবে সুশাসন, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বিষয়ে জ্ঞান দিতে হবে। তাকে বুঝাতে হবে সততা, নীতি, ন্যায়পরায়ণতা, ধর্মসহ একটি মানুষের জীবনের দায়িত্ব-কর্তব্য। একজন ব্যক্তি যখন এসকল বিষয়ে জ্ঞান থাকবে তখন সে ইচ্ছে করলেই যে কোন কিছু করতে চিন্তা করবে। একজন ব্যক্তি জীবনে সততা থাকতে হবে। সততা তখনই সম্ভব যখন সৎ কে মানুষ সংজ্ঞায়িত করতে পারবে। একজন ব্যক্তি নিজেকে বলবে আমি একজন সৎ ব্যক্তি। যে যার অবস্থা থেকে এভাবে আওয়াজ তুলতে হবে। তাহলে সম্ভব হবে সততা প্রতিষ্ঠা করা।

    শিক্ষা মানুষকে শিক্ষিত করে; কিন্তু সর্বদা সুশিক্ষিত করতে পারে না। সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য নৈতিকতা থাকাটা জরুরি। সমাজে নীতিবান ও সুশিক্ষিত মানুষের বড়ই অভাব রয়েছে। যা বর্তমানে অতি প্রয়োজন। একজন সফল মানুষ হতে হলে নৈতিকতার কোন বিকল্প নেই। যার মধ্যে নৈতিকতা নেই সে প্রকৃত মানুষ হতে পারে না। বাহ্যিক দিক থেকে যদিও সে ধনবান বা ক্ষমতাবান হন।

    সুশিক্ষা ও নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ তৈরিতে পরিবারের বড় একটি ভূমিকা থাকে। এর পাশাপাশি সরকারেরও ভূমিকা রয়েছে। কারণ নৈতিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হতে হলে যে বিষয়গুলো এড়িয়ে চলা প্রয়োজন, তা আজও সমাজে প্রচলিত।

    যেমন- মাদকদ্রব্য, পর্নোগ্রাফি, ধূমপান ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্ব দেয়া দরকার। তা না হলে অল্পবয়সী তরুণ-তরুণীরা সামাজিক পারিপার্শ্বিকতা বুঝে ওঠার আগেই ঝরে পড়বে। অথবা ভুল পথে যাবে। বর্তমানে করোনা পরিস্থিেিত প্রায় সকল ছাত্রছাত্রী অনলাইনে ইন্টারনেটের মাধ্যমে মোবাইল অথবা কম্পিউটার দিয়ে তাদের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার ক্লাস করছে। এই জন্য ঝুকি আরো একটু বেড়ে গেছে।
    ইসলাম ধর্মের মূল শিক্ষা হচ্ছে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। সব আসমানি কিতাবেই এ বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধই মানুষকে অন্য সব প্রাণী থেকে আলাদা করে। যার নীতিনৈতিকতা নেই, মানবিক মূল্যবোধ নেই; সে ধার্মিক হতে পারে না। কারণ ধর্মের শিক্ষাই হলো সত্যতা, সততা, পবিত্রতা। ধর্ম মানুষের কল্যাণের জন্য এবং অকল্যাণ থেকে পরিত্রাণের জন্য।

    দেশের প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা নানাভাবে বিভক্ত। বাংলা, ইংরেজি ও মাদ্রাসা শিক্ষা প্রচলিত রয়েছে। সরকারি প্রাইমারি স্কুলের পাশাপাশি আছে কিন্ডারগার্টেন ও এনজিও পরিচালিত স্কুল। বিদ্যালয়ে আজকাল নৈতিক শিক্ষা তথা সুস্থ-সুন্দর জীবন যাপনের পথনির্দেশ; বা যথার্থ মানুষরূপে গড়ে উঠার জন্য চরিত্র গঠনের উপর তেমন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। পারিবারিকভাবেও নৈতিক মূল্যবোধ ও মানবিক গুণাবলী বিকাশের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে অনেক কম।

    সুস্থ বিনোদন ও সুকুমার বৃত্তি বিকাশের যে সুযোগ-সুবিধা অতীতে ছিল তাহা বর্তমানে নাই বললেই চলে। নৈতিকতা ও সুকুমার বৃত্তির অনুশীলনের ক্ষেত্রে পরিবারের পরই কার্যকর অবদান রাখতে পারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রাথমিক থেকে শুরু করে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে নৈতিক মূল্যবোধ, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষা ও চরিত্র গঠনের উপর গুরুত্ব আরোপ করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো এখন সময়ের দাবি। এক শ্রেণীর কিশোর-কিশোরী ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে গড্ডলিকা প্রবাহে। মাদকাসক্তিসহ নানাবিধ অনাচারে জড়িয়ে পড়তেছে তাদের অনেকেই। কিশোর-যুবকদের আরেকটা শ্রেণী টেন্ডারবাজি, খুন-খারাবি ও লুটপাটের সহিত যুক্ত হয়ে পড়তেছে। এর ফলে সমাজে এক অসহনীয় পরিবেশের সৃষ্টি হচ্ছে। সমাজ-সভ্যতার স্বাভাবিক বিকাশের পথ ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে আসতেছে।

    এই পরিস্থিতির জন্য আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার দায় নেহায়েত কম নয়। দুঃখজনক হইলেও সত্য, এক শ্রেণীর শিক্ষক-শিক্ষিকা কেবল পুস্তক দেখে পাঠদান কিংবা মাল্টিমিডিয়ার সাহায্যে প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে শিক্ষাদান করেই তাহাদের দায়িত্ব শেষ করতে চান। শিক্ষার্থিগণের মানসিক বিকাশের বিষয়ে তারা মোটেও মনোযোগী নয়। অথচ ছেলেমেয়েদের চিত্তবিকাশ না ঘটলে, ভাল ও মন্দের বিচারবোধ না জন্মাইলে কারো পক্ষে যথার্থ শিক্ষিত হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই হল সুপ্ত মানবিক গুণাবলীর সম্যক বিকাশ। সেইসব গুণের যথাযথ বিকাশ ঘটলে স্ব স্ব ক্ষেত্রে মানুষ যেমন হয়ে ওঠেন দক্ষ, তেমনই তাহার বিকশিত নৈতিক বুদ্ধি জীবনের সুন্দরতর পথে চালিত করে। সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহমর্মিতা ইত্যাদি গুণেরও বিকাশ ঘটে, ব্যক্তিত্বে বহিঃপ্রকাশ ঘটে চারিত্রিক দৃঢ়তা, যা দেশ ও জাতি গঠনে সহায়ক হয়।

    এমতাবস্থায় বাংলা, ইংরেজী ও মাদ্রাসার ক্ষেত্রে দশম শ্রেণী পর্যন্ত নৈতিকতা, চরিত্র গঠনমূলক পাঠ কার্যক্রম চালু করা আবশ্যক। মানবিকতা ও সুকুমার বৃত্তি বিকাশে সহায়ক কর্মকান্ড প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়মিত পরিচালিত হওয়া উচিত। ইংরেজি মাধ্যমের ক্ষেত্রেও অন্তত সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। স্কুল ও মাদ্রাসাগুলোয় নিয়মিতভাবে খেলাধুলার চর্চা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কিশোর-কিশোরীরা যাতে মাদকাসক্ত হয়ে না পড়ে কিংবা অন্যকোনো প্রকার অনৈতিক কার্যকলাপের সহিত যুক্ত হয়ে না পড়ে সেই জন্যে পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সচেতন দৃষ্টি রাখা একান্ত কর্তব্য। শিক্ষক সমাজকে বর্তমানের নতুন প্রজন্মের জিজ্ঞাসা ও মূল্যবোধ গঠনে সহায়তা প্রদানকারীর ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রত্যেকে যাতে তাহাদের নিজ নিজ ধর্ম পালনের পাশাপাশি অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে সেই জন্যেও ধর্মীয় গোঁড়ামিমুক্ত পাঠক্রম অন্তর্ভুক্ত করিতে হইবে। ইন্টারনেটের এই যুগে শিশু বয়স হতেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশাল জ্ঞানভান্ডারের ভাল দিকটাই যাতে শিশুরা ব্যবহার করতে পারে, সেইদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আসলে চরিত্র গঠন, নৈতিক মূল্যবোধ ও মানবিকতাসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থার কোন বিকল্প নাই।

    লেখক : উন্নয়ন ও সমাজকর্মী


    error: Content is protected !! please contact me 01718066090